ছবিঃ সংগৃহীত।
২০২৪ সালটা শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়। সারাবিশ্বের জন্যই ২০২৪ সাল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, কূটনৈতিক ইত্যাদি না ঘটনার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। পুরো বিশ্বের ঘটনা এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে সবচাইতে আলোচনা হয়েছে যেসব বিষয়গুলোকে নিয়ে এবং যেসব ঘটনা বিশ্বকে সবচাইতে বেশি প্রভাবিত করেছে সেগুলোর মধ্য থেকে বাছাই করা কিছু ঘটনা নিয়েই এই প্রতিবেদন।
বছরের প্রথম দিনেই ৭.৬ মাত্রার তীব্র ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে উদীয়মান সূর্যের দেশ। আঘাত হানে সুনামিও। প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রাণ হারান শতাধিক মানুষ, ক্ষয়ক্ষতিও হয় বিস্তর।
ভারত-মালদ্বীপ সংঘাত- ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির লাক্ষাদ্বীপ সফরের পরেই মালদ্বীপ-ভারত সংঘাত তুঙ্গে ওঠে। মোদিকে নিয়ে নানা বিতর্কিত মন্তব্য করেন দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জুর দলের একাধিক নেতা। এমনকী ভারতের সমুদ্র সৈকতগুলো নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত বলেও কটাক্ষ করেন সেদেশের কয়েকজন নেতা। তারপরই নিন্দার ঝড় ওঠে। গোটা ভারত জুড়ে শুরু হয় ‘বয়কট মালদ্বীপ’।
কিন্তু সমস্ত কিছু নস্যাৎ করে বিপুল জনসমর্থন পান হাসিনা। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ফের সরকার গড়ে তাঁর দল আওয়ামী লীগ। ১০ জানুয়ারি টানা চতুর্থবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন মুজিবকন্যা।
তাইওয়ানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন- ১৩ জানুয়ারি তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্ট হন লাই চিং তে ওরফে উইলিয়াম লাই। তার এই জয়ে অস্বস্তি বাড়ে চিনের। বরাবরই অভিযোগ ছিল, এই নির্বাচনে কলকাঠি নাড়ছে বেজিং। তাইপেইতে নিজের পছন্দের প্রেসিডেন্ট চাইছিল কমিউনিস্ট দেশটি। আর সেই কারণেই লাইকে ‘বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে প্রচার চালিয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত শেষ হাসি হাসেন শাসক ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির নেতাই। এর আগে তিনিই ছিলেন তাইওয়ানের ভাইস প্রেসিডেন্ট।
ভোটের ফল গণনার পর দেখা যায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, শাহবাজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন)। সবচেয়ে বেশি আসনে জয় পান ইমরানের দল পিটিআই সমর্থিত নির্দলরা। কিন্তু নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার কারণে তারা সরকার গঠন করতে পারেননি। ফলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন শেহবাজ শরিফ।
হাইতিতে হাহাকার- চরম অরাজকতা, লুঠতরাজে জেরবার ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ছোট দেশ হাইতি। মাফিয়াদের তাণ্ডবে বিপন্ন সাধারণ মানুষের জীবন। ১৫ মার্চ রাজধানী পর্তোপ্রাঁসের ৮০ শতাংশ দখল করে নেয় বিভিন্ন গ্যাং। ইস্তফা দিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়াল হেনরি। একাধিক শহরের কারাগার ভেঙে অপরাধীদের বেরও করে দেয় মাফিয়ারা। এমনকী প্রধানমন্ত্রী যাতে আর সুরক্ষিতভাবে দেশে ফিরতে না পারেন তার জন্য হাইতির প্রধান বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণও নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে তারা।
টানা পঞ্চমবার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন তিনি। ইউক্রেন যুদ্ধ, বিরোধী নেতা নাভালনির মৃত্যু কোনও কিছুই প্রভাব ফেলেনি নির্বাচনে। ১৯৯৯ সাল থেকে রাশিয়ার মসনদে রয়েছেন পুতিন। এবারেও রেকর্ড ভোটে জিতে ২০৩০ পর্যন্ত ক্ষমতায় রাশ ধরে রাখলেন তিনি। এই মেয়াদ যদি শেষ করতে পারেন তাহলে রাশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে প্রেসিডেন্ট থাকার নজির গড়বেন পুতিন। টপকে যাবেন জোসেফ স্ট্যালিনকেও।
ব্রিটিশ রাজবধূর ক্যানসার– ২৩ মার্চ ফের ফের ব্রিটিশ রাজ পরিবারের দুঃসংবাদ মেলে। ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার খবর নিজেই জানান ব্রিটেনের রাজবধূ কেট মিডলটন। গত প্রায় এক বছর ধরে লন্ডনের একটি ক্লিনিকে তাঁর পেটে বেশ কয়েকবার অস্ত্রোপচার হয়। অবশেষে জানা যায়, তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত।
এই হামলার পিছনে ইজরায়েলকে দায়ী করে তেহরান। লাগাতার সতর্কবার্তার পর ১৩ এপ্রিল ইজরায়েলে একের পর এক মিসাইল ছুড়তে শুরু করে ইরান। সব মিলিয়ে ৩০০টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়। ১৯ এপ্রিল ইসলামিক দেশটিকে পালটা মার দেয় ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ)। তীব্র বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ইরানের একাধিক শহর। ছড়িয়ে পড়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক।
তাইওয়ানে ভূমিকম্প- ৩ এপ্রিল ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে তাইওয়ান। রিখটার স্কেলে তীব্রতা ছিল ৭.৪। মৃত্যু হয় প্রায় ১০০ মানুষের, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও ব্যাপক। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে বড় বড় হোটেল। ফাটল ধরে একাধিক সড়কে। গত ২৫ বছরের মধ্যে এটাই তাইওয়ানে হওয়া সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প।
বন্যায় বিধ্বস্ত ব্রাজিল- ৫ মে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে ব্রাজিল। সঙ্গে দোসর প্রবল বর্ষণ। প্রকৃতির রুদ্ররোষে মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায় এবং বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হন প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ। প্লাবনে তলিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। বন্যার জেরে ব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ রিও গ্র্যান্ডে ডো সুলে পানির তলায় চলে যায়। এই প্রদেশের রাজধানী তথা ব্রাজিলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর পোর্তো আলেগ্রের অবস্থা ছিল সবচেয়ে খারাপ। সব মিলিয়ে অন্তত ৪৯৭টি শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত ৮০ বছরের মধ্যে এটাই ছিল ব্রাজিলের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা।
দক্ষিণ গাজার এই শহরে অভিযান শুরু করা নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে আমেরিকার। তেল আভিভে অস্ত্রের সরবরাহে হ্রাস টানে হোয়াইট হাউস। রাষ্ট্রসংঘের তোপের মুখে পড়েন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
সেই কর্মসূচিই ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনে। একটি পার্বত্য অঞ্চল পেরিয়ে যাওয়ার সময় কপ্টারটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উত্তর-পশ্চিম ইরানের একটি পাহাড়ে আছড়ে পড়ে। এই দুর্ঘটনায় ইজরায়েলের দিকে ষড়যন্ত্রের আঙুল ওঠে। কিন্তু সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দেয় তেল আভিভ।
ঋষি সুনাকের পরাজয়- ৫ জুলাই ব্রিটেনের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়। নজির গড়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন কেয়ার স্টারমার। তাঁর দল লেবার পার্টির কাছে ভরাডুবি হয় কনজারভেটিভ পার্টির। প্রধানমন্ত্রীর গদি হারান ঋষি সুনাক। ১৪ বছর পর টোরি শাসনের অবসান ঘটে রাজার দেশে।
ইরানে নির্বাচন- ইব্রাহিম রাইসির আকস্মিক মৃত্যুর পর নির্বাচন হয় ইরানে। ৬ জুলাই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সংস্কারপন্থী নেতা মাসুদ পেজেস্কিয়ান। জোর টক্কর দিয়ে তিনি পরাজিত করেন কট্টরপন্থী নেতা সাইদ জালিলিকে। পেজেস্কিয়ানের শপথগ্রহণে গিয়েই গুপ্তঘাতকের হাতে তেহরানে মৃত্যু হয় হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়েহর। এই খুনে অভিযোগের আঙুল ওঠে ইজরায়েলের দিকে।
৫ আগস্ট শিক্ষার্থী-জনতার গণ অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছাড়েন মুজিবকন্যা। এরপর ৮ আগস্ট বাংলাদেশের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।
লেবাননে হামলা ইসরায়েলের- ১৯ সেপ্টেম্বর পেজার বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে লেবানন। সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর সদস্য-সহ প্রাণ যায় অন্তত ৫০০ জনের। আহতের সংখ্যা ৪ হাজার পেরিয়ে যায়। এই ঘটনার পরদিন থেকেই লেবাননে হামলা শুরু করে ইজরায়েল। ২৭ সেপ্টেম্বর ইজরায়েলি সেনার অভিযানে নিহত হন হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লা। কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর উত্তরসূরি হাশেম সাফেদ্দিনকেও খতম করে তেল আভিভ। নয়া কমান্ডার হিসাবে নাইম কাসেমের নাম ঘোষণা করে হিজবুল্লাহ। এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ইরানও।
বোমার আঘাতে কার্যত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে গাজা। এখনও পর্যন্ত গাজায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪৬ হাজার প্যালেস্তিনীয়। নিহত শতাধিক ইজরায়েলি সেনাও। রাষ্ট্রসংঘ-সহ আন্তর্জাতিক মহলে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়লেও সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে তেল আভিভ। এক বছর পূর্ণ হলেও মেলেনি রফাসূত্র। এর মধ্যেই ১৭ অক্টোবর ইজরায়েলের হামলায় খতম হয় নয়া হামাস প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার।
নির্বাচন জিতে দুরন্ত প্রত্যাবর্তন ঘটান তিনি।
তারপর একে দারা, হোমসের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করার পর ৮ ডিসেম্বর রাজধানী দামাস্কাসে পৌঁছয় বিদ্রোহীরা। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাহিনীকে পিছু হঠতে বাধ্য করে তারা। পতন ঘটে আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসনের।
সবুজ জ্বালানির দ্রুত রূপান্তর- পরিবেশের সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় জ্বালানির উৎস দ্রুত বদলে ফেলছে দেশগুলো। পুরনো তেল-কয়লার জায়গা নিচ্ছে লিথিয়াম, কপার ও নিকেলের মতো নবায়নযোগ্য বা সবুজ জ্বালানি। সবুজ জ্বালানির জন্য প্রতিযোগিতা ভূ-রাজনীতি ও বাণিজ্যকে নতুন আকার দিচ্ছে।
পশ্চিমা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা- চলতি বছর প্রত্যাশার চেয়ে ভাল করেছে পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনীতি। কিন্তু এখনও বিপদমুক্ত নয়। সুদহার এখনও অনেক বেশি, যা কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি ভোক্তাদের আরও ভোগাবে।
সামনের দিনগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বোত্তম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কেমন হতে পারে এবং ‘অস্তিত্বগত ঝুঁকি’ মোকাবিলা নিয়ে বিতর্ক আরও তীব্র হবে।
এরপরও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপ্রত্যাশিত ব্যবহার ও অপব্যবহার বাড়তে থাকবে। চাকরির বাজারে এর প্রভাব এবং নির্বাচনে হস্তক্ষেপের আশঙ্কা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের দুইবছর- ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২২। ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে রাশিয়া। সীমান্ত পেরিয়ে বাঁধভাঙা জলের মতো ঢুকে পড়ে রুশ সেনারা।
দুই প্রাক্তন সোভিয়েত সদস্যভুক্ত দেশের মধ্যে শুরু হয় প্রবল যুদ্ধ। কিন্তু এখনো কিয়েভ দখল করতে পারেননি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এরইমধ্যে যুদ্ধে কয়েক হাজার সেনা ও বিপুল অস্ত্র খুইয়েছে মস্কো। দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই করে ভাঁড়ারে টান পড়েছে ইউক্রেনেরও। কিন্তু থামেনি সংঘাত। এভাবেই যুদ্ধের দুবছর পূর্ণ করেছে দুপক্ষ। একের একের বিপুল অঙ্কের সামরিক প্যাকেজ ঘোষণা করে বন্ধু কিয়েভের পাশে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh