ছবিঃ সংগৃহীত।
আজকের তরুণ আগামী দিনের ভবিষ্যত্। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তারুণ্যের মধ্যেই সর্বদা লুকায়িত সব বাধা-বিপত্তি, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার উজ্জীবিত শক্তি। বৃদ্ধের প্রজ্ঞা, পরামর্শ আর তারুণ্যের শক্তি একটি জাতির সমৃদ্ধি অর্জনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়ে থাকে। তাই বলা হয়, ‘তারুণ্যেই শক্তি, তারুণ্যেই মুক্তি’। পৃথিবীর যত মহত্কর্ম সাধিত হয়েছে, মুক্তির উদ্যম হাওয়া যত প্রান্তর বেয়ে প্রবাহিত হয়েছে তার প্রত্যেকটির পেছনে অসামান্য অবদান রয়েছে তরুণদের। আর এই তারুণ্যের শক্তির আশ্রয়ে পৃথিবীকে বদলে দিতে চাই তরুণদের সঠিক পথে চালিত করার দিকনির্দেশনা। তরুণদের শুভ শক্তির দ্যুতি ছড়িয়ে মহত্ত্ব এক পৃথিবীর জন্ম ঘটাতে তরুণদের চালিত করতে হবে আলোর পথে, মুক্তির পথে।
শেরে বাংলা, বঙ্গবন্ধু, ভাসানী, নজরুলরা হলেন এই বাংলার তেমনই সর্বজন সমাদৃত ব্যক্তি। সময় স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া কিংবা সময় যুদ্ধে হেরে যাওয়া অক্ষমের মতো আবেগ বিষণ্নতায় ভোগা জীবনের মতো তাদের অগ্রযাত্রা থেমে ছিল না। তারা ছিলেন সময়ের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। তাদের প্রতিভা, সাহস, দৃঢ়তা বাঙালি কখনো ভুলবে না। বাঙালিকে পথপ্রদর্শন করা তাদের মহত্ পরার্থপরতা পৃথিবী থেকে মূর্ছিত হবে না কোনোদিনও।
ইতিহাস বারবার এগিয়ে আসে তরুণদের অবদানকে স্মরণ করিয়ে দিতে। বলা হয়ে থাকে তরুণ্যের চোখে বিশ্বকে জয় করা যায়। কিন্তু আজকের দিনে তরুণদের বিচরণ চার দেওয়ালেই সীমাবদ্ধ। যে তরুণদের বিচরণে রাজপথ, খেলার মাঠ চারপাশ হই-হুল্লোড়ে মুখরিত থাকত, সেই তরুণরা আজ যেন কোথায় হারিয়ে গেছে বাংলা থেকেই। আজ বাঙালি, ইছামতী, করতোয়া নদীর বুকে একঝাঁক তরুণের উন্মুক্ত সাঁতার কাটার দৃশ্যও তেমন চোখে পড়ে না। ভাসানীর মতো দুষ্টুমিতে ভরপুর শৈশব, বঙ্গবন্ধুর মতো সবার হয়ে মুক্তির কথা বলা কৈশোর, আর টগবগে রক্তের শেরে বাংলার মতো প্রতিবাদী যুবকের বাংলার চিরচেনা পথে-প্রান্তরে আর বিচরণ করতে দেখা যায় না। এক জনের রক্তের জবাবে হাজার তরুণের বুক পেতে অবলীলায় তাজা রক্ত বিলিয়ে দেওয়ার সমৃদ্ধ এবং শানিত ইতিহাস বাংলার আছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তরুণদের সাহসী এবং আত্মত্যাগের মহিমা বাঙালির প্রেরণার হাতিয়ার।
গৌরবময় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিকামী বাঙালির মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের পর ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ইতিহাস আরেকটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকলো। এর আগে, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান তরুণ নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল। ইতিহাসের দিকে তাকালে এটি স্পষ্টতই যে, যুগে যুগে সৎ ও মেধাবী তরুণরা দেশকে নানাভাবে এগিয়ে নিয়েছেন। তরুণদের জাগরণ ও একতাবলের অবিশ্বাস্য এক শক্তি সবসময় বিজয়কে তরান্বিত করেছে, তা প্রমাণিত। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অভূতপূর্ব ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এ দেশের তরুণরা প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়েছেন।
২০১৮ সালের সরকারের কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে গত ৫ জুন হাইকোর্ট রায় দেন। এর আগে বাংলাদেশের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা প্রথা বাতিল করে ওই ব্যবস্থা পুনর্মূল্যায়ন করতে হাইকোর্টে ৩১ জানুয়ারি একটি রিট দায়ের করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আবদুল অদুদ ও আনিছুর রহমান মীর। রায়ে ২ থেকে ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। ৭ জুলাই শিক্ষার্থীরা ‘বাংলা ব্লকেড’-এর ডাক দেয়। যার আওতায় তারা বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। ৮ ও ৯ জুলাই একই রকম কর্মসূচি পালন করা হয়।
১০ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে কোটা বৈষম্য দূর করে অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম ৫ শতাংশ কোটা বহাল রেখে কোটা সংস্কারের এক দফা দাবি আদায়ে জড়ো হয়ে শাহবাগ অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শিক্ষার্থীদের সামনে ব্যারিকেড দিয়ে অবস্থান নেয়। দুপুরে জানা যায়, কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে চার সপ্তাহ স্থিতাবস্থা দেওয়া হয়। প্রধান বিচারপতি শিক্ষার্থীদের ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেন। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অবরোধের কারণে ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থা স্থিমিত হয়ে আসে। দূরপাল্লার বাসগুলো আন্দোলনের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ১১ জুলাই শিক্ষার্থীরা শাহবাগে যাওয়ার পথে পুলিশ বাধা দেয়। আন্দোলন শেষ করে তাদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে ১২ জুলাইয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের ঘোষণা দেয়।
১২ জুলাই বিকেল ৫টায় শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের সতর্কবাণী উপেক্ষা করে শাহবাগে জড়ো হয়ে অবরোধ করে। বিকেল ৫টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন বাজার-সংলগ্ন ঢাকা-রাজশাহী রেললাইন অবরোধ শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। এতে সারাদেশের সঙ্গে রাজশাহীর রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৩ জুলাই রাজশাহীতে রেলপথ অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। ১৪ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকায় গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে।
১৫ জুলাই আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্য অপমানজনক। এই বক্তব্য আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, গত রাতে বিক্ষোভ করে আমরা ১২টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে তার বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলাম। প্রত্যাহার না হওয়ায় আমরা রাস্তায় নেমেছি।
১৬ জুলাই দুপুর আড়াইটা থেকে তিনটার দিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ গুলি চালালে আবু সাঈদ নামের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী আহত হন। তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মো. ইউনুস আলী জানান, এক শিক্ষার্থীকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। এ ছাড়া আহত অবস্থায় আরও ১৫ জন হাসপাতালে এসেছেন। এ সময় সারাদেশে সংঘর্ষে আরও তিনজন নিহত হন, যার মধ্যে প্রথমজন চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম, দ্বিতীয়জন ওমরগণি এম.ই.এস. কলেজের শিক্ষার্থী ও ছাত্রশিবির নেতা ফয়সাল আহমদ শান্ত এবং তৃতীয়জন পথচারী।
১৮ জুলেই রাত ১২টার দিকে রাতে বাসায় ফেরার পথে সিয়াম নামের এক তরুণ যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ রাজধানীর উত্তরায় কোটা সংস্কারের আন্দোলনের পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হলে তার বন্ধু জাকিরুল ইসলাম তাকে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা বিভাগে নিয়ে গেলে চিকিৎসা শেষে ডাক্তার রুম থেকে বের হয়ে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় সংঘষে আহত হয়ে নিহত হন ফারহান ফাইয়াজ। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় সংবাদপত্র অনুযায়ী ১৯ জুলাই শুক্রবার সারাদেশে কমপক্ষে ৫৬-৬৬ জনের মৃত্যু হয় বলে জানানো হয়।
২০ জুলাই রাত ১টা ৫১ মিনিট কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলামকে মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে যায়, যদিও বিষয়টি তারা অস্বীকার করে। ২১ জুলাই ভোরে ঢাকার পূর্বাচল এলাকায় আন্দোলের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে পাওয়া যায় ও পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করেন তাকে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। এদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি পক্ষ ‘৯ দফা’ দাবি জানিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।
২২ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম চার দফা দাবি জানিয়ে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত করেন।
১৯ জুলাই থেকে নিখোঁজ থাকার পর ২৪ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদের খোঁজ পাওয়া যায়। রাত পর্যন্ত আরও ৪ জনসহ মোট ২০১ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। সেদিন পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় পুলিশ ১,৭৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করে। ২৫ জুলাই বিকেল পর্যন্ত ব্রডব্যান্ডে ধীরগতির ইন্টারনেট পাওয়া যায়।
২৬ জুলাই নাহিদ ইসলামসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায় সাদাপোশাকের এক দল ব্যক্তি। তারা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়েছেন বলে সেখানে উপস্থিত এক সমন্বয়কের স্বজন ও হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান।
২৭ জুলাই তিন সমন্বয়ককে ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার জুনায়েদ আলম জানান, নিরাপত্তার স্বার্থে তিন সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজতে নিয়ে আসা হয়েছে।
২৮ জুলাই রাত ৯টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সংগঠনের আরও দুই সমন্বয়ককে হেফাজতে নেয় গোয়েন্দা শাখা। তারা হলেন সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ। সেদিন ভোরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। সব মিলিয়ে মোট ৬ জন সমন্বয়কারীকে আটক করে সরকার। রাত ১০টার দিকে পুলিশি হেফাজতে থাকা ৬ সমন্বয়ক আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। কিন্তু পুলিশের হেফাজতে থেকে গোয়েন্দা অফিসে বসেই বাকি সমন্বয়কারীদের সাথে যোগাযোগ না করে এমন ঘোষণা দেওয়ায় এটা সরকার ও পুলিশের চাপে দেয়া হয়েছে বলে আখ্যায়িত করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় সহযোগী সমন্বয়করা।
১ আগস্ট গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে বেলা দেড়টার একটু পরেই ছেড়ে দেওয়া হয়। সারাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এবং ৯ দফা দাবি আদায়ে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজত থেকে ছাড়া পাওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছয় সমন্বয়করা ২ আগস্ট গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন যে, আন্দোলন প্রত্যাহার করে ডিবি অফিস থেকে প্রচারিত ছয় সমন্বয়ককের ভিডিও স্টেটমেন্টটি তারা স্বেচ্ছায় দেননি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে বলেন, গণভবনের দরজা খোলা। তবে দুপুরে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম জানান, সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। যখন আমরা ডিবি হেফাজতে ছিলাম, তখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরা এই প্রস্তাবের প্রতিবাদে ডিবি হেফাজতে অনশন করেছিলাম।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ মন্তব্য করেন, তাদের সাথে আলোচনার কোন পরিকল্পনা আমাদের নেই। আমাদের দাবি অত্যন্ত সুস্পষ্ট, তাদের কোন বক্তব্য থাকলে দেশবাসীর সামনেই মিডিয়া মারফত তা রাখতে পারেন। আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার সিদ্ধান্তই আমাদের সিদ্ধান্ত। গুলি আর সন্ত্রাসের সঙ্গে কোন সংলাপ হয় না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা ও হত্যার প্রতিবাদসহ পূর্বঘোষিত নয় দফা দাবিতে ৩ আগস্ট সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও ৪ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। গণভবনে জরুরি বৈঠকে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দলকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনা করার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী।
৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ১ দফা দাবি করে নতুন কর্মসূচি লং মার্চ টু ঢাকা ঘোষণা করে। প্রথমে ৬ আগস্ট পালন করার কথা থাকলেও পরে তা ৫ আগস্ট করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এক জরুরি সিদ্ধান্তে আমাদের ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ৬ আগস্ট থেকে পরিবর্তন করে ৫ আগস্ট করা হলো। অর্থাৎ আগামীকালই সারাদেশের ছাত্র-জনতাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আহ্বান জানাচ্ছি। অসহযোগকর্মসূচি ঘিরে ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপক সংঘর্ষ ও হানাহানির ঘটনায় অন্তত ৯৮ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন মেহেদি হাসান নামে তরুণ সাংবাদিকও ছিলেন।
৫ আগস্ট সকালের পরিবেশ বেশ থমথমে, সতর্ক অবস্থানে ছিল ঢাকার পুলিশ। তবে কারফিউ অমান্য করে বেলা ১১টার পর থেকে সারাদেশের শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণ শাহবাগে জড়ো হতে থাকে। তারপর শাহবাগ থেকে আন্দোলনকারীরা গণভবনের দিকে পদযাত্রা শুরু করেন। এ সময় শেখ হাসিনা বেলা দুইটার দিকে পদত্যাগ করেন এবং আড়াইটার দিকে বঙ্গভবন থেকে একটি সামরিক হেলিকপ্টার করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেন। তারপর বিকেল তিনটার দিকে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন এবং শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এই আন্দোলনে সাধারণ নাগরিকরা শিক্ষার্থীদের ওপর ভরসা রেখেছিলেন। তরুণদের সঙ্গে অকাতরে জীবন বিলিয়েছেন নাম না জানা সমাজের নানা স্তরের মানুষ। এই আন্দোলনের সম্বল ছিল ছাত্রসমাজ তথা তারুণ্যের অদম্য সাহস ও অধিকার আদায়ের দঢ় সংকল্প। পরে একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন ছিল তাদের প্রেরণা। যে কারণে বাংলাদেশের রাজনীতির এক প্রতিকূল সময়ে কোটা ও বৈষম্যবিরোধী তরুণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সাহস পেয়েছে, আদায় করে নিয়েছে তাদের অধিকার। তরুণরা দেশের মানুষের মাঝে উপলব্ধি জাগ্রত করতে পেরেছেন। নাগরিকের সংকট আর সম্ভাবনাকে সামনে রেখে সব প্রতিকূলতা ছাপিয়ে তরুণরা সম্মিলিত গণমানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। কেবল অধিকার আদায়ে তরুণরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।
একটি রাষ্ট্রে বা কোনো সমাজেই নিজে থেকে ‘অটো’ কোনো পরিবর্তন আসে না। যে ধরণেরই পরিবর্তন হোক না কেন তার পেছনে অবশ্যই সেই ধরণের কারণ থাকে। অন্যদিকে সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনার পরিবর্তন না ঘটলে রাষ্ট্রের মৌলিক সমস্যার সমাধানেও কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটে না। বাংলাদেশের ইতিহাসের আলোচিত বা স্মরণীয় সকল আন্দোলন বা বিজয়ের তরুণরা প্রমাণ করেছেন যে, সামাজিক শক্তির সবচেয়ে বড় উৎস-উদ্যমী তরুণ সমাজ।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিপ্লবের এ প্রেক্ষাপটে আন্দোলনের নায়ক হিসেবে তরুণ নেতৃত্বের বীরত্বগাঁথা সামনে আসতে থাকে। এই তরুণদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যে সরকারের প্রধান নোবলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও ছাত্রসমাজ বা তরুণদের অবদানকে বারবার স্বীকার করে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে যাচ্ছেন। চব্বিশের শহীদ ও আহতদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন দলমত নির্বিশেষে বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখা মানুষেরা। স্মরণ করছেন তরুণদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বগাঁথাকে। তারুণ্যের এই অদম্য শক্তি আগামির বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনে শক্তি ও সাহসের প্রতীক হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী-তরুণ সমাজ অসীম সাহস আর অদম্য স্পৃহা নিয়ে স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে তারা পুলিশের বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে দিয়ে গেছেন নতুন বাংলাদেশকে। এমন উদ্যমী, সাহসী ও অধিকারসচেতন তারুণ্যকে রুধিবার সাধ্য কার?
তবে ধীরে ধীরে তরুণরা আবারো তাদের পথ হারাতে শুরু করেছে।
এমতাবস্থায় এই তরুণ প্রজন্মের চেতনায় বিস্তর পরিবর্তন ঘটাতে দেশের সচেতন সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে অবশ্যই। তরুণদের হতাশা দূর করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা; তরুণদের সঙ্গে মনোবিদদের দিয়ে নিয়মিত কথা বলার ব্যবস্থা করে দিতে পারলে তরুণদের হতাশা এবং হতাশার কারণ সহজেই নিরূপণ করা যাবে। তরুণদের নিঃসঙ্গ জীবনের পরিবর্তন ঘটাতে পরিবারের ভূমিকা অপরসীম, তাই পরিবারকে তাদের সন্তানের মতের মূল্যায়ন করতে হবে। মাদকের নেশা থেকেও বর্তমানে স্মার্টফোন আসক্তি তরুণদের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠছে। তাই প্রযুক্তি যেন ছেলেমেয়ের উর্বর ভবিষ্যত্ নষ্টের কারণ না হয় সেদিকে অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh