ছবিঃ সংগৃহীত।
প্রায় ১৭ বছর ধরে শোষণের শিকার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির আগুন যখন প্রায় নিভু নিভু তখন অনেকেই শেষ দেখছিলেন দলটার। এ বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর সেই নিভু নিভু আগুন আবারো জ্বলে ওঠে বিএনপি’র। রাজনীতির মাঠে আবারো সরব হয় শহীদ রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত এই দলটি। মাঠ পর্যায়ে পুরোদমে চলছে সংগঠনটির দল গোছানোর কাজ। বড় বড় সব মামলা থেকে প্রত্যহার পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ১১ বছর পর দেশে ফিরেছেন মির্জা আব্বাস। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও দেশের জনগণের কাছে দলটির একমাত্র চাওয়া নির্বাচন। তবে সে পথে এগুতে গিয়ে কোন পথে হাঁটছে বিএনপি?
৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে কারাগার থেকে মুক্তি পান দলটির কয়েক হাজার নেতাকর্মী। বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘ সময় বিদেশে অবস্থান নেওয়া দলটির নেতাকর্মীরাও দেশে ফিরতে থাকেন।
দলটির পছন্দের লোকজন দায়িত্ব পান রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। বলা যায়, আগামী দিনে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বিএনপি। সবমিলিয়ে অসাধারণ ও অকল্পনীয় একটি বছর পার করছে দলটি।
দেখা যাচ্ছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দল গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বিএনপি নেতারা। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও হচ্ছে সভা-সমাবেশ। বলা যায়, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের ১৬ বছরে কোণঠাসা হয়ে পড়া দলটির পালে হাওয়া লেগেছে। তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে মাঠের রাজনীতিতে। তবে রাষ্ট্র পুনর্গঠনে দলটির সামনে এখনও রয়েছে নানামুখী চ্যালেঞ্জ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি এখন সংগঠন গুছিয়ে নিয়ে এসে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। তবে বিগত দিনে দেওয়া ৩১ দফার রূপরেখা যে কথার কথা নয়, তা প্রমাণ করতে হবে কাজের মাধ্যমে। তাদের সংস্কার প্রস্তাবগুলো নতুন আঙ্গিকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে।
বিএনপির এখন সম্ভাব্য সুদিন। একই সঙ্গে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ায় চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়েছে তারা। বিএনপি বড় রাজনৈতিক দল। তারা অতীতেও ক্ষমতায় ছিল। আগামী নির্বাচনে প্রতিপক্ষ কে হবে, সেই প্রস্তুতি তাদের নিতে হবে। আর নির্বাচনের সময় সীমা নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কের ভেতর দিয়েই বিএনপিকে তার রাজনীতির কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
যদিও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার করে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন দেবে বলে আশা করছে দলটি।
সম্প্রতি এক ভিডিওবার্তায় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, আগামী নির্বাচনে প্রতিপক্ষ নেই এটি ভাবা যাবে না; অতীতের যেকোনো নির্বাচনের থেকে এই নির্বাচন হবে অনেক কঠিন। তাই নিজেদের সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে। নেতাকর্মীদেরকে ৩১ দফার পক্ষে জনসমর্থন নেওয়ার জন্য কাজ করতে হবে। জনগণের মন জয়ের জন্য কাজ করতে হবে।
বিএনপি’র নতুন চ্যালেঞ্জ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ভিন্ন রকম এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। আগামী নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র সংস্কারের ব্যাপারে নিজেদের প্রস্তাবনা ও দলীয় নেতাকর্মীর কর্মকাণ্ড দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে দলটিকে। রাজনীতিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ এখন কঠিন সংকটে। এবারের নির্বাচনে সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় নামতে হতে পারে বিএনপিকে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলকে নিয়ে ইসলামী ফ্রন্ট এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-তরুণদের সম্ভাব্য নতুন দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হতে পারে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলটিকে।
একই সঙ্গে বিএনপিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে নিয়ে যেতে হবে দেশকে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, দেশের সামরিক-বেসামরিক শক্তি ও সুশীল সমাজের সমর্থন আদায়ও করতে হবে। সঙ্গে রয়েছে লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ।
দলটির নেতারা বলছেন, সমমনা দলগুলোকে নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের নতুন প্রস্তাব দিয়ে দেশি-বিদেশিদের আস্থা অর্জনে তারা আশাবাদী। একই সঙ্গে তারা দলকে সুসংগঠিত করে নতুন সব চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করবেন। আগামী নির্বাচনে জনগণের সমর্থন নিয়ে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসবেন।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে আন্দোলন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। দ্বাদশ সংসদের একতরফা নির্বাচনের ছয় মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতনে বদলে যায় দৃশ্যপট। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারামুক্ত হন। রাজনৈতিক মামলায় দলের কারাবন্দি সর্বস্তরের নেতাকর্মীরাও বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে দলটির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠছে। এতে দলটি আবার জনপ্রিয়তা হারানোর চ্যালেঞ্জে পড়েছে। যদিও দলটির হাইকমান্ড কঠোর অবস্থান নিয়ে অনেককে বহিষ্কার করেছেন।
তীর হারা ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিয়ে বিএনপি
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তার স্ত্রী খালেদা জিয়া দলটির হাল ধরেন। তার নেতৃত্বে তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে বিএনপি। অন্তর্বর্তী সরকার তাকে মুক্তি দিলেও রাজনীতিতে নেই তিনি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তার ছেলে তারেক রহমান লন্ডন থেকে দল পরিচালনা করছেন। এতে সক্রিয় উপস্থিতির শূন্যতা পূরণ হচ্ছে। দলের নেতারাও দাবি করছেন, এখন ডিজিটাল যুগে সশরীরে উপস্থিতির কাজ ভার্চুয়ালি সম্ভব হচ্ছে।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমবার সংকটে পড়েছিল বিএনপি। আশির দশকে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর দ্বিতীয়বার গভীর সংকটে পড়ে দলটি। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সময় খালেদা জিয়াসহ বিপুল সংখ্যক শীর্ষ নেতা কারাবন্দি হলে দলটি তৃতীয় দফা নেতৃত্ব সংকটে পড়ে। তিনবারই ভাঙনের মুখে পড়েছিল দলটি। তবে এবার তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলটি সুশৃঙ্খলভাবে সংগঠিত হয়েছে।
নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ও ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি
বিএনপির নীতিনির্ধারক নেতাদের মতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সফলতার মধ্য দিয়ে বিএনপির ১৫ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। ছাত্র-জনতার নির্দলীয় নেতৃত্ব মেনে নিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছিল দলটি। এ আন্দোলনে নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির উত্থান ঘটেছে। রাজনৈতিক দলগুলো তা মেনেও নিয়েছে।
তাদের মতে, ফ্যাসিবাদী বনাম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের যে মেরূকরণ ছিল, তা শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার নতুন মেরূকরণ তৈরি করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে এসেছে।
দেশে রাজনৈতিক বিভাজন স্পষ্টত। একদম খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপিকে তুলনা করছে। বিশেষ করে দুই দলের নেতাকর্মীর কার্যক্রমকে অনেকেই একই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বলে অভিহিত করছেন। এ পরিস্থিতিতে সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলদারির অভিযোগগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে শুরু করেছে বিএনপি।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh