চিকিৎসক হয়ে ‘হার্টের রিং (স্টেন্ট) বিক্রি করেন, হার্টের রক্তনালীতে একটি রিং পরিয়ে তিনটির টাকা নেন, রক্তনালীতে ব্লক না থাকলেও ব্লক আছে বলে ভয় দেখিয়ে আতংকিত’ করে তোলেন রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের আনীত এমন সব লিখিত অভিযোগ সরেজমিন তদন্তে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
রংপুর বিভাগের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. হারুন-অর-রশিদকে তদন্ত কমিটির সভাপতি এবং রংপুরের ডেপুটি সিভিল সার্জনকে সদস্য সচিব করে এই পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। রংপুর বিভাগের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য)-এর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ কমিটি গঠনের বিষয়টি জানা যায়।
কমিটির অন্যান্য সদস্যগণ হলেন:, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের কার্ডিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান; নীলফামারী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান; এবং ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, রংপুর জেলার ঔষধ তত্ত্বাবধায়ক। এদিকে তদন্ত প্রতিবেদন আগামী সাত কর্ম দিবসের মধ্যে ঢাকাস্থ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক বরাবর পাঠাতে বলা হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয় তদন্ত কমিটি আগামী ৩০ ডিসেম্বর সকাল ৯:৩০ ঘটিকার সময় বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য)-এর কার্যালয়, রংপুরে তদন্ত কাজ পরিচালনা করবে।
এর আগে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. হরিপদ সরকারকে সভাপতি করে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে হার্টে সার্জারি করে নিজেই রিং বিক্রি করে বসালেও কার্ডিওলজি বিভাগ এ অনিয়মের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বর্তমান পরিচালক দায়িত্ব নেয়ার পর ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কিন্তু এ কমিটি ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম শেষ হবার কথা থাকলেও তা পেরিয়ে গেচে। এখন পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
উল্লেখ্য যে, ৭ ডিসেম্বর হাসপাতালের পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন একই হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ শাহিন শাহ্। ডাঃ শাহিন শাহ’র খালু আফজাল হোসেন (৬৫) ডা. মাহাবুবের অধীনে রিং পরানোর পর মারা যান গত বছরের ৭ নভেম্বর। অন্যদিকে, ডাঃ মাহবুবুরের বিরুদ্ধে হার্টের রক্তনালীতে রিং পরিয়ে ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় স্বামী লাল মিয়া (৫০) মারা যাওয়ার ৮ নভেম্বর আরেকটি লিখিত অভিযোগ করেন গাইবান্ধা সাঘাটা উপজেলার কচুয়া গুজাপাড়া গ্রামের মোসা. ফরিদা বেগম। ২১ সেপ্টেম্বর ডা. মাহবুবের প্রতারণার শিকার বদরগঞ্জের মাসুমা বেগমের ছেলে মোহা. মশিউর রহমান লিখিত অভিযোগ করেন যে হার্টের রক্তনালীতে ব্লক না থেকেও ব্লক আছে এমন প্রতারণা করার জন্য। ২৩ নভেম্বর গাইবান্ধার ভুক্তভোগী আতোয়ার রহমানও ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন একটি রিং পরিয়ে তিনটির টাকা নেওয়ার জন্য।
রংপুর দুর্নীতি দমন কমিশন অফিসে ভুক্তভোগী ডা. মাহবুবের প্রতারণার এই চারটি অভিযোগ দুনীতি দমন কমিশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল ঢাকা, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এবং রংপুর সিভিল সার্জন অফিসে ডাকযোগে এবং সরাসরি পাঠিয়ে ডা. মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
হাসপাতালের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক ও নার্সরা ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে রিং ও অন্যান্য সরঞ্জমাদি বিক্রির অভিযোগ মৌখিকভাবে অবগত করলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগসহ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক কোনো ব্যবস্থা নেননি। বরং তদন্ত কার্যক্রম শুরুর পর অবৈধ আয়ের গোমর ফাঁস হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ডা. মাহবুবুর রহমান। নিজের দোষ ঢাকতে মরিয়া হয়ে ওঠা এই চিকিৎসক বিভিন্ন মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের ম্যানেজ করার মিশনে ব্যর্থ হন।
এরপরই কয়েকটি গণমাধ্যমে ডা. মাহবুবুর রহমানের ‘সাফল্য’ তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশিত হয়। যাতে দীর্ঘ ছয় বছর ধরে হাসপাতালের বন্ধ থাকা ক্যাথল্যাবটি মাহবুবুর রহমানের প্রচেষ্টায় চালু এবং হার্টে রিং স্থাপনসহ অন্যান্য কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে দাবি করা হয়। তদন্ত কার্যক্রম চলাকালে তদন্ত প্রভাবিত করার অপচেষ্টা থেকে এমন সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীসহ সচেতন মহল।
প্রকাশিত সংবাদগুলো এই প্রতিবেদকের নজরে আসার পর অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ১০ ও ১১ ডিসেম্বর স্থানীয় ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত দুটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খরবটিতে নতুন কোনো তথ্য নেই। বরং আট মাস আগে মার্চ মাসে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ক্যাথল্যাব চালুর সংবাদটি হুবহু প্রকাশ করা হয়। যেখানে শুধুমাত্র পূর্বের পরিচালকের নামের জায়গায় পরিবর্তন করে লেখা হয়েছে একজন ডাক্তার জানান। সচেতন মহলের দাবি, নিজের অপকর্ম ঢাকতে সাফল্যের ঢোল পেটাতে গিয়েও ভুল করেছেন ডা. মাহবুবুর রহমান। এখন প্রশ্ন উঠছে, ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধি করতেই কী মাহবুবুর রহমান ক্যাথল্যাব চালুর উদ্যোগ নেন?
অন্যদিকে ডা. মাহবুবুর রহমান তার চেম্বারের সামনে বিভিন্ন ডিগ্রি উল্লেখ করে আগের টাঙানো নেমপ্লেট সরিয়ে নিয়েছেন। সেখানে এখন শুধু নিজের নাম ও পদবি উল্লেখ করে নতুন নেমপ্লেট টাঙানো হয়েছে। হঠাৎ দীর্ঘদিন ধরে টাঙানো নেমপ্লেট পরিবর্তন করায় তার ডিগ্রি নিয়েও নানান প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ রোগী, ভুক্তভোগী ও সচেতন মহলের মাঝে।
যদিও বিভিন্ন মিডিয়াতে দেয়া সাক্ষাতকারে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ডা. মাহবুবুর রহমান বলেছেন, প্রত্যেকটা রোগীর হার্টে রিং স্থাপনের পর তাকে রিপোর্ট কপি এবং সিডি দেওয়া হয়। সেখানে বিস্তারিত তথ্য থাকে। এরপরও যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে এটা দুঃখজনক। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হার্টে রিং বসানো বা স্থাপন এবং এনজিওগ্রাম খরচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় কম হওয়ায় কিছু সিন্ডিকেট ও কুচক্রী মহল রোগীর স্বজনকে ভুল বুঝিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। কোনো অর্থনৈতিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত নন বলেও দাবি করেন এই চিকিৎসক।
এদিকে ডা. মাহবুবুর রহমান যখন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে যাচ্ছেন, এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে উচ্চতর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভুক্তভোগীসহ সচেতন মহল বলছেন, তদন্ত প্রভাবিত না হলে ডা. মাহবুবুর রহমানের রিং বাণিজ্যের থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। একই সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের মুখোশও উন্মোচন হবে।
রংপুর মডেকিলে কলজে (রমকে) হাসপাতালরে পরচিালক ব্রগিডেয়িার জনোরলে আশিকুর রহমান জানান, কয়েকজন ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে তদন্ত কমটিি করা হয়েছে। ওই চিকিৎসক দোষী কিনা এবং তদন্ত কমিটির মতামত দেখে পরর্বতী পদক্ষপে নেওয়া হবে।