ছাত্র-জনতার কাঙ্খিত নতুন বাংলাদেশ গড়তে আইন, বিচার, শিক্ষা, অর্থনীতিসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে সংস্কার শেষে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারে যারা আছেন তাদের প্রতি আমরা আস্থা রাখতে চাই। আমরা ক্ষমতার কাঙ্গাল হয়ে যাইনি। তিন মাস বা ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনও চাই না। আমরা আগে সংস্কারগুলো দেখতে চাই। আমরা প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই। অনুভব করতে চাই টাকার জোরে কেউ আবার ভোট প্রতিহত করতে পারবে না। টাকার জোরে কেউ গুন্ডা বা পুলিশ কিনতে পারবে না। পুলিশকে সংস্কার করে নতুন ভাবে সাজাতে হবে। যখন মনে হবে সত্যি সত্যি মুক্তভাবে মানুষ ভোট দিতে পারবে, তখনই নির্বাচন চাইব। এর জন্য কতদিন লাগবে, আমি জানি না। যোগ্য লোক দেড়-দুই বছরে শেষ করতে পারে। যদি বাধা হয় তাহলে তিন বছরও লাগতে পারে। আমাদের কাছে ক্ষমতার লালসা আসে নাই যে ছয় মাসের মধ্যে ভোট করে দিতে হবে।
সোমবার (১৯ আগস্ট) দুপুরে রংপুর নগরীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে নাগরিক ঐক্যের নেতা-কর্মীদের সাথে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন নাগরিক ঐক্য রংপুর জেলা আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আজাদ।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারে যারা আছেন, তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই, তারা কেউ রাজনীতিবিদ নন। তাই রাজনৈতিকভাবে ও প্রশাসনিকভাবে কতটা মোকাবিলা করতে পারেন, সেটা আমাদের দেখতে হবে। তাই আমাদের সমর্থন নিরঙ্কুশ না হলেও সমর্থনটা চালিয়ে যেতে চাই। যতদিন রাষ্ট্র সংস্কারে সময় লাগে, ততদিন আমরা সমর্থন রাখতে চাই।
দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবি করা বিএনপি-জামায়াত নেতাদের ইঙ্গিত করে ডাকসুর সাবেক ভিপি বলেন, এই ছাত্ররা যদি লড়াইটা না করত, তাহলে এত অল্প সময়ের মধ্যে শেখ হাসিনার সরকার যেত না। আর যদি না যেত তাহলে আরো চার বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকত। সেই চার বছর আপনাদের অপেক্ষা করতে হতো আর পুলিশের ডান্ডা, আর্মির থ্রেট এবং সমস্ত অন্যায়-অনাচারের মুখে থাকতে হতো। এই ছাত্র-জনতা লড়াই করে জীবন দিয়ে একটা মুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে। আর আপনারা সাথে সাথেই বলছেন নির্বাচন দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বুক ভরে শ্বাস নেয়া যায় এমন একটা নতুন বাংলাদেশ চাই। যেখানে প্রাণ ভরে চতুর্দিকে তাকাতে পারব। কোনো মানুষকে পছন্দ হলে তার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারব। কারো প্রতি যদি খারাপ কিছু হয় দুঃখ হয় তাকে যেন সেই কথা বলতে পারি। এবং এই কারণে কেউ আবার ঘাড়ে চেপে ধরবে মারবে জেলে পাঠিয়ে দিবে_ এই রকম পরিস্থিতির অবসান চাই। আইন, বিচার, শিক্ষা, অর্থনীতির সংস্কার চাই। একটা কল্যাণকর বাংলাদেশ চাই। যেখানে মানুষের কল্যাণ করাটাই হবে রাষ্ট্র যারা চালান তাদের সবার লক্ষ্য।
অন্যায়কারী মানুষের সামনে দাঁড়াবার সাহস পায় না উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান বলেন, দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ চার-পাঁচজন পালিয়েছেন। পুলিশের সবচেয়ে বড় কর্মকর্তা আইজিপির খবর নাই। বহু থানাতে ওসি নাই। এত অত্যাচার মানুষের ওপর করেছে, এখন তারা মানুষের সামনে দাঁড়াবার সাহস পায় না। ওই মানুষগুলোকে (নির্যাতিত) বাঁচাতে হবে। সেই জায়গায় নতুন পুলিশ দিতে হবে। যারা সত্যিকার জনগণের বন্ধু। আমরা চাই পুলিশ জনগণের বন্ধু হোক। আমরা জনগণের দোড়গোড়ায় বিচার ব্যবস্থা চাই। হাই কোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট নিজেরাই নিজেদের ক্ষমতাকে সেইরকম করে সাজাক যাতে মানুষ সরাসরি বিচার পায়। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি দমাতে হবে। সড়কপথে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। মাস্তানি-গুন্ডামি বন্ধ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীরা নতুন বাংলাদেশ দেখতে চায়। আমরাও তাদের সাথে চাই এমন একটা বাংলাদেশ যেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে। সত্য প্রাধান্য পাবে। সম্মানী মানুষ সম্মান পাবে। লুটপাট বন্ধ হবে। মানুষ নিজের পছন্দ মত ভোট দিয়ে পছন্দের সরকার নির্ধারণ করবে। সেই রকম নতুন বাংলাদেশ আমরা চাই। যেটা হবে কল্যাণকর রাষ্ট্র। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ থাকবে। রাষ্ট্রসেবা মানুষের দুয়ারে পৌঁছবে। হয়রানি থাকবে না মানুষ ন্যায় বিচার পাবে। শহর-গ্রামের মানুষ সমানভাবে চিকিৎসাসেবা পাবে। নতুন বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচারকে জনগণের কাছে সুলভ করতে হবে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ডাকসুর সাবেক এই ভিপি বলেন, বীর সাহসী শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ দেই। যারা এই আন্দোলনকে চূড়ান্ত পরিণতিতে নিয়ে গেছেন। আমরা রাজনীতিক দলগুলো জমি তৈরি করেছিলাম এটা ঠিক। ত্যাগ-তিথীক্ষা, অত্যাচার-নিপীড়ন আমরাও কম সয়েছি তা নয়। কিন্তু তারপরও সত্য এই আন্দোলনকে বিজয়ের দরজায় আমরা নিতে পারিনি। আমাদের দরকার ছিল ঠিক আবু সাঈদের মতো সাহস করে বলা ‘হয় তুই নইলে আমরা’। হয় শোষণ নইলে জনগণ। হয় ন্যায় নইলে অন্যায়-নির্যাতন-লুটপাট। কিন্তু জিতবে তো শেষ পর্যন্ত ন্যায়-সত্য এবং তাই জিতেছে। আমরা রাজনীতিক দলগুলো সেই চ্যালেঞ্জ সরকারের সাথে করতে পারিনি। মানুষের মধ্যে চেতনা জাগরণ করা। ভোট কেড়ে নেবার বিরুদ্ধে লড়াই করা। লুটপাটের বিরুদ্ধে কথা বলা। এই সব রাজনীতিক দলগুলো করেছিল। আমি তাদেরকেও ধন্যবাদ দেই।
তিনি আরও বলেন, দম্ভ টিকে না। অত্যাচারী টিকে না। অহংকার মানুষ সহ্য করে না। মানুষ মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিবে। মানুষ মানুষের মতো প্রত্যেকে বাঁচবে। একটা মানুষের যেমন সম্মান আরেকটা মানুষেরও তেমন সম্মান। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার সেই সম্মান নিতে দেয়নি। অথচ এই বাংলাদেশকে স্বাধীন করবার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়েছে। মা-বোন ইজ্জ্বত দিয়েছে। এতো বড় লড়াইয়ের পরেও এই দেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আমল থেকে এই পর্যন্ত যতবার ক্ষমতায় গেছে একই কায়দায় অন্যায়-অত্যাচার করেছে। মানুষ দুঃশাসন, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষ জেগেছে।
মাহমুদুর রহমান বলেন, শেখ হাসিনার সরকার বিগত ১৫ বছর ধরে লাগাতার নির্যাতন চালিয়েছে। পাখির মত মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে। আয়নাঘর তৈরি করে মানুষকে মাসের পর মাস আটকে রেখে নির্যাতন করেছে। আর বাংলাদেশের সমস্ত সম্পদ লুট করেছে। শেখ হাসিনার এই ভয়াবহ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে মানুষ ফুঁসে উঠেছিল। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী শাসকের পতন হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ কোটি শেখ হাসিনা লুট করেছেন। চুরি করেছেন। একটা আপদামস্তক চোরের সরকার লুটেরা সরকার ১৫ বছর আমাদের ওপর দাপট দেখিয়েছে। তারা দেশের উন্নয়ন করেছে আমরা দেশের বিরোধিতা করেছি। আমরা দেশদ্রোহিতা করছি আমরা নাকি দেশের ক্ষতি করছি। মানুষ জবাব দিয়েছে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি বলেন, দেশের স্বাধীনতা একবারই আমরা লাভ করেছিলাম। কিন্তু বিগত ১৬ বছর আমাদের স্বাধীনতা-দেশ ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল, সেই ছিনতাই হওয়া দেশকে মুক্ত করে দিয়েছে ছাত্র-জনতা। অথচ আমরা আওয়ামী লীগের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে, জমি দখল নিয়ে ভাবছি। এগুলো বন্ধ করতে হবে। এগুলো চলতে থাকলে, যে লাউ সেই কদুর মতোই হবে। এ সময় তিনি নিজ দলের নেতাকর্মীদের দল গোছানোর আহবান জানিয়ে বলেন, ভালো মানুষ না থাকলে ঘুরে ফিরে তারাই আসবে। এজন্য দুর্বৃত্ত সরাতে হলে ভালো কিছু নিয়ে আসতে হবে। যাতে মানুষ ভোট দেয়ার সময় ভালো মানুষকে খুঁজে পায়।
শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলা প্রসঙ্গে মাহমুদুর বলেন, যারা আবু সাঈদ হত্যার সাথে জড়িত তাদের কোন দায়িত্বে রেখে তদন্ত পরিচালনা করা যাবে না। তাদের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করতে হবে।
মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য রাখেন- ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বাবলু, নাগরিক ঐক্যের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোফাখখারুল ইসলাম নবাব প্রমুখ। অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের রংপুর জেলা ও মহানগরের নেতা-কর্মী ছাড়াও বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সাহিদার রহমান জোৎস্না।
এরপর মাহমুদুর রহমান মান্না দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে রংপুরের পীরগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সেখানে তিনি শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত শেষ করে বগুড়ায় যাবেন।